হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:
সেন্টমার্টিনদ্বীপে ভাঙ্গণ রোধে স্বেচ্ছাশ্রমে কেয়াগাছ রোপন করা হয়েছে। ৭ আগস্ট সোমবার সকালে সেন্টমার্টিনদ্বীপের জন্য ব্যতিক্রমধর্মী ও মহতী কাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন ৬নং সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার আলহাজ্ব মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান খান প্রকাশ হাবিব খান। সংখ্যায় কম হলেও দ্বীপ রক্ষার এই মহতী কাজে স্বেচ্ছাশ্রমে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় আরও কয়েকজন। এরা হলেন ২নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুল আমিন, মৎস্য ব্যবসায়ী আব্দুল হামিদ, কটেজ ম্যানেজার মোহাম্মাদ আলম, কামাল, আব্দুর রহিম।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউনিয়নের মেম্বার আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান খান প্রকাশ হাবিব খান বলেন ‘সেন্টমার্টিনদ্বীপ প্রতিষ্টাকালের পুরানো ইতিহাস বিখ্যাত কেন্দ্রীয় কবরস্থানের ভয়াবহ ভাঙ্গন, কবরস্থান সী-বীচ সংলগ্ন উত্তর পাশের ভয়াবহ ভাঙ্গন রোধে সরকারী বরাদ্দ না থাকায় কেয়াগাছ রোপন আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমরা ৭ আগস্ট সোমবার সকালে স্বেচ্ছাশ্রমে দেড় শতাধিক কেয়াগাছ রোপন করেছি। দ্বীপ রক্ষায় বিশেষতঃ ইতিহাস বিখ্যাত কেন্দ্রীয় কবরস্থানের ভয়াবহ ভাঙন রোধে সরকারী বরাদ্দ না পেলেও আমরা সর্বসাধারণকে সাথে নিয়ে প্রাণপন চেষ্টা অব্যাহত থাকবে’।
তিনি আরও বলেন ‘শীতের পর্যটন মৌসুমে সেন্টমার্টিনদ্বীপটি দেশী-বিদেশী পর্যটক ভিআইপি, পদস্থ কর্মকর্তা সকলের কাছে স্বপ্নের দ্বীপ হয়ে যায়। কিন্ত বর্ষা মৌসুমে এই দ্বীপের কথা কারও মনে থাকেনা। অসহায় দ্বীপবাসীর কান্না তাঁদের কর্ণকুহরে পৌঁছেনা। এমনকি ভয়াবহ ভাঙ্গণ রোধে কার্যকরী উদ্যোগ এবং ক্ষতিগ্রস্থদের খোঁজ পর্যন্ত নেয়া হয়না’। জরুরী ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় কবরস্থানের ভয়াবহ ভাঙ্গন রোধে জিওব্যাগ বালি ভর্তি একশ ফুটের কমপক্ষে ১০টি বস্তা দান করে এগিয়ে আসতে সরকার দলীয় এমপি আলহাজ্ব আবদুর রহমান বদি সিআইপির দৃষ্টি আকর্ষণ এবং দানশীল ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানায়ে বলেন ‘দ্বীপ থাকলেই থাকবে আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছুই। সব বিষয়ে স্বার্থ আর রাজনীতি না খোজে দ্বীপের উন্নয়নে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একমত হতে হবে। এক প্লাটফর্মে আসতে হবে, তাহলেই দ্বীপ রক্ষা হবে, দ্বীপের উন্নয়ন হবে, অন্যতায় তিলে তিলে সবকিছুই ধ্বংস হবে যাবে আমরা বুঝে উঠার আগেই। এ দ্বীপে মানুষের বসবাস শুরু হয় প্রায় ৩ শতাধিক বছর আগে। দ্বীপে বসতি শুরুর পর এভাবে কোনোদিন এখানে পানি ওঠেনি। এ রকম ভয়াবহ ভাঙ্গনও আগে কোনো সময় দেখা যায়নি। জোয়ারের পানি আর সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে দ্বীপে চারপাশেই ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। বেশি ভেঙ্গেছে উত্তর-পশ্চিম অংশে। এদিকে বিস্তীর্ণ কেয়া বন সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। দ্বীপের একমাত্র কবরস্থানটির প্রায় দেড়শ’ ফুটেরও বেশি সাগরে তলিয়ে গেছে। মাটি সরে যাওয়ায় স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িসহ আশপাশের কয়েকটি সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে কবর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের কঙ্কালও’।
দ্বীপের বাসিন্দাগণ জানান ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৪ সালের জলোচ্ছ্বাসসহ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এ দ্বীপে পানি ওঠেনি। ভাঙনের সমস্যাও তেমন একটা ছিলনা। কিন্তু দ্বীপে বসতি শুরুর দীর্ঘ দুইশ’ বছর পর বিগত বছরগুলোতে পূর্ণিমার জোয়ারে হঠাৎ সেন্টমার্টিনে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। দ্বীপের চতুর্দিকে ভাঙন শুরু হয়। ভাঙনের কবলে পড়ে দ্বীপের চারপাশে বিশাল অংশ পানিতে তলিয়ে যায়। ভাঙন কবল থেকে রক্ষায় পায়নি দ্বীপের আটটি বসতঘরসহ প্রায় ২১টি স্থাপনা সাগরে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙনের কবলে পড়ে দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিম অংশে অবস্থিত একমাত্র একমাত্র কবরস্থানটির ১৫০ ফুটেরও বেশি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে। ফলে শঙ্কিত হয়ে পড়ে দ্বীপের বাসিন্দারা।
জানা যায়, ভয়াবহ ভাঙ্গণে ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। বঙ্গোপসাগরের করাল গ্রাসে আশংকাজনকভাবে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে সেন্টমার্টিনদ্বীপের মানচিত্র। সেন্টমার্টিনদ্বীপের উত্তর এবং পশ্চিম অংশে ভাঙ্গছে বেশী। এমনিতেই স্বাভাবিক সময়েও পূর্ণিমা-অমাবশ্যার ‘জো’ চলাকালে সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে দ্বীপের বিভিন্ন অংশে নিত্য নতুন ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। উপরন্ত ঘুর্ণিঝড় মোরার আঘাত এবং অবিরাম বর্ষণে বর্তমানে ভাঙ্গণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দুইশতাধিক বছর আগে থেকে বসতি শুরু হয় দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমাটিনে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ ভয়াবহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ টেকনাফ উপকূলে আঘাত হানলেও কখনো মনোবল ভাঙেনি সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর। কিন্তু সম্প্রতি এ দ্বীপে দু’টি জলোচ্ছ্বাসে আঘাত হানে এবং দ্বীপের চারপাশে ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি হওয়ায় নতুন করে ভাবনায় পড়েছে দ্বীপের প্রায় ৯ হাজার বাসিন্দা। সরকারি-বেসরকারিভাবে স্থাপনা নির্মিত হলেও নির্মিত হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। পর্যটন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা ধরে রাখতে মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি দীর্ঘ দিনের। বর্তমানে ভাঙনের কবলে পড়ে ৮.৩ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপটি দিন দিন ছোট হয়ে আসায় দেশের মানচিত্র থেকে দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন দ্বীপবাসী।
সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর আহমদ বলেন ‘দ্বীপের চতুর্দিকে বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের কবলে পড়ে বহু বসতবাড়ি ও সরকারি বেসরকারী অবকাঠামো সাগরে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙন রোধে ক্ষতিগ্রস্তরা ব্যক্তি উদ্যোগে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে চাইলে প্রশাসন বাধা প্রদান করে। আমি সেন্টমার্টিনদ্বীপের চতুর্দিকে এ দ্বীপের পরিবেশ, পর্যটন ও জীববৈচিত্র রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ৮.৩ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপটি দিন দিন ছোট হয়ে আসায় দেশের মানচিত্র থেকে দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দ্বীপের পরিবেশ, পর্যটন ও জীববৈচিত্র রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে সমন্বয় সভায় উত্থাপন, সংবাদ সম্মেলন এবং বহু আবেদন করে আসছি দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্ত কোন ফলোদয় হচ্ছেনা।
তাছাড়া অবিরাম প্রবল বর্ষন উপরন্ত পূর্ণিমা-অমাবশ্যার ‘জো’ তে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পেয়ে সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে দ্বীপের উত্তর কোনায় ভয়াবহ ভাঙ্গণ সৃস্টি হয়ে ২১টি বসত বাড়ি সাগরে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ঘুর্ণিঝড় মোরার আঘাতে এবং বর্ষা শুরুতে দ্বীপের উত্তর এবং পশ্চিম অংশে ভাঙ্গণ ধরেছিল। কিন্ত এবারে ২১টি পরিবারের বসত ভিটা সম্পুর্ণ সাগরের করাল গ্রাসে চলে যায়। ভয়াবহ ভাঙ্গণে বসতবাড়ি ও ভিটে হারা ২১টি অসহায় পরিবারের নারী পুরুষ শিশু নিরুপায় হয়ে বর্তমানে আতœীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দ্বীপের বিভিন্ন অংশে বিশেষতঃ উত্তর-পশ্চিম অংশে ভাঙ্গণ শুরু হলে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনসহ উর্ধতন মহলকে অবহিত করেছি। এমনকি দ্বীপের চতুর্দিকে পরিবেশ সম্মত টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উর্ধতন কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়েছি। এব্যাপারে লিখিত আবেদন ছাড়াও টেকনাফ উপজেলা পরিষদের মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় গুরুত্ব সহকারে বার বার উত্থাপন করে দ্বীপের ভাঙ্গণ রোধে জরুরী ভিত্তিতে জিও ব্যাগ স্থাপনের দাবি জানানো হয়েছে। বর্তমানে দ্বীপের উত্তরাংশের বসতবাড়ি, প্রাচীণতম একমাত্র কবরস্থান, পুলিশ বাহিনীর জমি চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন। জরুরী ভিত্তিতে জিও ব্যাগ স্থাপন অথবা বাঁধ নির্মাণ করা না হলে ভাঙ্গণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে’।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকারী বিধি-নিষেধের কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন এমনকি দ্বীপ রক্ষার কাজ বন্দ রয়েছে।